মহাস্থান নিউজ:
বগুড়ার মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালের ৫০ কেলভিন ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ট্রান্সফার স্টেশন সাতমাস ধরে বিকল হয়ে আছে। সচল একমাত্র ট্রান্সফরমার স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের। সাম্প্রতিক সময়ের লাগাতার লোডশেডিংয়ে রোগীদের ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। কোনো ধরনের জেনারেটর সুবিধা না থাকায় বিশেষ করে দুপুরের পর লোডশেডিং চলাকালে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
হাসপাতালের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের এমন সংকটের কথা স্বীকার করছেন দায়িত্বশীলরা। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ অফিসের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের পরেও কোনো সুরাহা হয়নি বলে জানান হাসপাতালটির আবাসিক মেডিকেল অফিসার শফিক আমিন কাজল।
তবে বিদ্যুৎ বিভাগ দাবি করছে, গুরুত্ব বিবেচনায় হাসপাতালে সাধারণত দুটি লাইন দেয়া আছে। নষ্ট হওয়া ওই ট্রান্সফরমারটি অতিরিক্ত। ওই ট্রান্সফরমারটি না থাকলেও হাসপাতালে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো সমস্যা হবে না।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল ও গণপূর্ত সূত্র জানায়, চিকিৎসা সেবা নিরবিচ্ছিন্ন রাখার সুবিধার্থে হাসপাতালে দুটি ট্রান্সফরমার আছে। একটি ২৩০ কেভি, এটি গণপূর্ত বিভাগ স্থাপন করে। এই লাইনটিকে বলা হয় মোহাম্মদ আলী ফিডার। অপরটি হাসপাতালের সামনের গেটের ধারে। ৫০ কেভির এই ট্রান্সফরমারটি দেখাশোনা করে নেসকো। একে বলা হয় ঠনঠনিয়া ফিডার।
মোহাম্মদ আলী ফিডার দিয়ে হাসপাতালের দক্ষিণ অংশের গাইনি ওয়ার্ড, কেবিন, অপারেশন থিয়েটার, জরুরী বিভাগের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। আর উত্তরপাশের হাসপাতালের প্রশাসনিক অংশ, বর্হিবিভাগ, মেডিসিন, সার্জারি ওয়ার্ডে ও পানি তোলার কাজে বিদ্যুৎ সরবরাহ হতো ৫০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফরমার থেকে।
তবে দুটো ট্রান্সফরমারের সঙ্গে পুরো হাসপাতালে দ্বৈতভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ করা ছিল। ফলে একটিতে লোডশেডিং হলে অপরটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতেন হাসপাতালের লোকজন।
এখানেই সংকটে পড়েছেন হাসপাতালের সবাই। কারণ গত বছরের ডিসেম্বরে ৫০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফরমারটি নষ্ট হয়। তখন থেকে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় হাসপাতালটি।
ডিসেম্বরে ঠনঠনিয়া ফিডার নষ্ট হওয়ার পর গণপূর্ত মেরামত করতে যায়। কিন্তু তখন নেসকো এই ফিডারকে নিজেদের দাবি করে। ফলে গণপূর্ত সেটি ঠিক করতে পারেনি। পরে তারা মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সাবস্টেশনের সঙ্গে এই ফিডারের লাইন যুক্ত করে দেন। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহটি চালু থাকে হাসপাতালে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের সময় দ্বৈত সেবা থেকে বঞ্চিত হয় হাসপাতালটি।
এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী মো. মিরাজুল ইসলাম জানান, ঠনঠনিয়া ফিডারের ৫০ কেভি ট্রান্সফরমার খুব বেশি বিদ্যুতের লোড নিতে পারে না। তবে সেটি থাকলে দ্বৈত বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল। কিন্তু ওটা পিডিবির (বর্তমান নেসকো), এ জন্য ওটা আমরা মেরামত করিনি। তবে আমাদের নিয়ন্ত্রণের মোহাম্মদ আলী ফিডারের ট্রান্সফরমারটি একটু দুর্বল ছিল। পর্যাপ্ত লোড নিতে পারতো না। সেখানে আজকে রোববার নতুন ট্রান্সফরমার বসানো হচ্ছে। এটি হলে হাসপাতালে বিদ্যুতের সংকট কিছুটা কমবে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গত সাত মাস ধরে হাসপাতালে লোডশেডিংয়ের সময় দ্বৈত বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছেন না তারা। এ ছাড়া হাসপাতালের উত্তর পাশের বিদ্যুৎ সেবায় ঘাটতি দেখা দেয়। হাসপাতালের তিনটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) আছে। যেখানে এই তিনটিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ টি অপারেশন হয়। কিন্তু ট্রান্সফরমার বিকল হওয়ায় ওটিতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু এতে দুপুর পর্যন্ত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ হলেও ঝামেলায় পড়তে হয় অফিস সময় শেষে বেলা ২ টার পর থেকে। কারণ তখন জেনারেটর বন্ধ থাকে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা তীব্র গরমে আরও নাজেহাল হয়ে পড়েন।
সম্প্রতি হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটে গিয়ে কথা হয় বগুড়া সদরের ঘোড়াধাপের বাসিন্দা মনিরের সঙ্গে। পিত্তথলির অপারেশনের পর সেখানে তার বাবা আব্দুল মোতালেবকে রাখা হয়। মনির জানান, গত সপ্তাহের মঙ্গলবার বাবাকে ভর্তি করানো হয়। এই কয়দিন দুপুরের পর থেকে কারেন্ট গেলে কোনো ফ্যান, লাইট বন্ধও থাকতো। খুব কষ্টে থাকতে হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারে নেয় ৯টার দিকে। বের করে সাড়ে ১১টার দিকে। এই সময়ের মধ্যেও দু’বার লোডশেডিং হয়েছিল। এ জন্য অপারেশনেও দেরি হয়েছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলার আমিরুল ইসলাম তার স্ত্রী চম্পা বেগমকে ভর্তি করেছেন সার্জারি ওয়ার্ডে। তিনি জানান, এত বড় সরকারি হাসপাতাল। অথচ বিদ্যুৎ গেলে জেনারেটরের ব্যবস্থা দেখলাম না। গরমে হাসপাতালে হাতপাখাই ভরসা।
আরএমও শফিক আমিন কাজল বলেন, ট্রান্সফরমারটি না থাকার কারণে আমাদের জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব নয়। আর অপারেশন সময় পার হওয়ার পর জেনারেটর চালু করা নিয়ম নেই। সেক্ষেত্রে লোডশেডিংয়ে রোগীরা সীমাহীন কষ্টভোগ করেন। ৫০ কেভি ট্রান্সফরমারটি স্থাপনের বিষয়ে নেসকোর সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে। কিন্তু এটি ঠিক করছেন না তারা। ট্রান্সফরমার না থাকলে রোগীদের জটিল মুহুর্তে বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালটি বগুড়ার নেসকো বিতরণ বিভাগ-১ এর আওতাভুক্ত। দপ্তরটির নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মোন্নাফ বলেন, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এখনও দুটো এইচটি লাইন আছে। নষ্ট হওয়া ট্রান্সফরমারটি একটি অপশনাল লাইন। হয়তো হাসপাতালের পানি তোলার জন্য এটি সংযোগ দেয়া হতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এটির প্রয়োজন নেই। বরং হাসপাতালে তিনটি লাইন একসাথে চালু রাখলে আরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে।